সাভার প্রতিনিধি : ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে প্রবল বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। সেভ দ্য চিলড্রেন এর তথ্য অনুযায়ী, হাজার হাজার শিশু এবং তাদের পরিবার বিভিন্নভাবে এই ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, যাদের এই মুহূর্তে জরুরি সাহায্যের প্রয়োজন।
বাংলাদেশের দক্ষিণের উপকূলীয় নিম্নাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় রেমাল-এর প্রভাবে গত রোববার ভারী বৃষ্টিপাত হয় এবং গত সোমবার পর্যন্ত বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ১৩৫ কিলোমিটার পর্যন্ত। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের মতে এই ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে প্রায় দেড় লাখ মানুষ, যার মধ্যে প্রায় ৭৬ লাখই শিশু। ঝড়ের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে প্রায় ৮ লাখ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং ৭৮ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে ত্রাণ তৎপরতায় সহায়তা করার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে। ঝড়ের প্রভাবে ব্যাপক জলোচ্ছ্বাসের কারণে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় এই অঞ্চলের মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আটকা পড়েছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূল অঞ্চলের মানুষের সুরক্ষা নির্বাহ করে উপকূলীয় বেড়িবাঁধের ওপর। বাঁধ ভালো থাকলে তারা দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাবে। আর বাঁধ ভেঙে গেলে তাদের ঘরবাড়ি, ফসলের খেত, রাস্তাসহ সবকিছু পানিতে ভেসে যায়। নিঃস্ব হয়ে পড়ে মানুষ।
চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, কক্সবাজার, লক্ষ্মীপুর, বরিশাল, ভোলা,ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং বাগেরহাট জেলার বিস্তৃত এলাকাজুড়ে সমুদ্র উপকূলীয় বেড়িবাঁধ প্রকল্প বা সিইপি। বাঁধ নির্মাণ এবং পানি নিষ্কাশনে এই প্রকল্পে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয় স্লুইস গেইট বা জলকপাট দ্বারা। সেইসঙ্গে পানি অপসারণের জন্য কার্যকর ব্যবস্থাও এখানে রয়েছে। প্রকল্পটি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক পরিচালিত। ১৯৬১ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে দুই পর্বে এটি বাস্তবায়ন করা হয়। প্রথম পর্বে প্রকল্পভুক্ত ছিল ৯২টি পোল্ডার নির্মাণ, যার মাধ্যমে ১০ লাখ হেক্টর ভূমি প্রকল্প সুবিধার আওতায় আসে। পোল্ডার একটি ডাস শব্দ, যার অর্থ বন্যা নিরোধের জন্য নির্মিত মাটির দীর্ঘ বাঁধ (ডাইক) দ্বারা বেষ্টিত এলাকা। দ্বিতীয় পর্বে ১৬টি পোল্ডারে আরো চার লাখ হেক্টর ভূমি উদ্ধার সম্ভব হয়। সিইপির আওতায় এ পর্যন্ত ৪,০০০ কিলোমিটারের অধিক দীর্ঘ বেড়িবাঁধ এবং ১,০৩৯টি নিষ্কাশন জলকপাট বা স্লুইস গেইট নির্মিত হয়েছে। সব ধরনের ডাইক বেড়িবাঁধ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। সমুদ্র ডাইকগুলো মূলত বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী এলাকায় সমুদ্রের মুখে অথবা প্রশস্ত নদীগুলির তীরে অবস্থিত। এসব স্থানে উঁচু ঢেউরাজি মোকাবিলায় এই বাঁধগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে ইতিবাচক ভূমিকার পাশাপাশি এসব বাঁধ সড়ক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হয়, যা উপকূলীয় অঞ্চলের সার্বিক আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে গতিশীলতার সঞ্চার করেছে। বেড়িবাঁধ জোয়ার পাবন থেকে ভূমিকে রক্ষা করতে কার্যকর, কিন্তু বাঁধের উচ্চতা ছাড়িয়ে যাওয়া জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ার জলোচ্ছ্বাসের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারে নি।
ঘূর্ণিঝড়ের পর ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের তালিকা অনুযায়ী দেশের ৩৩ উপজেলাকে সাগর-সংলগ্ন বিপত্সংকুল এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে সরকার। এসব উপজেলায় পরিকল্পিত উন্নয়ন কার্যক্রম না হওয়ায় ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। ঘূর্ণিদুর্গত এলাকাসমূহে এখনো নির্মিত হয়নি পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার। বছরের পর বছর ধরে বেড়িবাঁধগুলোও পুরোপুরি সংস্কার করা হয়নি। উপকূলীয় পোল্ডারগুলো অনেক পুরনো, বেশিরভাগেরই বয়স ৫০-৬০ বছরের বেশি। এগুলো মাটির তৈরি এবং যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। উপরন্তু চিংড়ি চাষের জন্য লবণপানি ঢোকানোর জন্য যত্রতত্র বাঁধের ভেতরে ছিদ্র করা বা পাইপ বসানোর ফলে এগুলো ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। ফলে পোল্ডারগুলোর অস্বাভাবিক জোয়ার কিংবা ঘূর্ণিঝড়ের সময় জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। উপকূলের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ও চরাঞ্চল জুড়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ এবং পুরনো বাঁধ সংস্কার প্রয়োজন। তাদের জন্য বেড়িবাঁধ টা আগে নির্মান করা দরকার। ভাত কাপড়ের চাইতে তাদের জন্য বেড়িবাঁধ টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজন ।