জাবি প্রতিনিধি: কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের দেওয়া বিভিন্ন স্লোগানের জেরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) মধ্যরাতে উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ক্যাম্পাস ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সোমবার (১৫ জুলাই) ভোর ৪টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে উত্তেজনা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্পাসে উপস্থিত রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ উপাচার্য শিক্ষা মোস্তফা মোহাম্মদ ফিরোজ।
এর আগে রবিবার (১৪ জুলাই) বিকালে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবনে সম্প্রতি চীন সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংবাদ সম্মেলনে প্রসঙ্গেক্রমে কোটা সংস্কার আন্দোলনও উঠে আসে। এসময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরাও পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে? আমার প্রশ্ন দেশবাসীর কাছে। তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে, মুক্তিযোদ্ধারা পাবে না। অপরাধটা কী? নিজের জীবনবাজি রেখে, সংসার সব ফেলে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। দিনরাত খেয়ে না খেয়ে, কাদামাটি ভেঙে, রোদ-বৃষ্টি-ঝড় মোকাবিলা করে যুদ্ধ করে এ দেশের বিজয় এনেছে। বিজয় এনে দিয়েছিল বলে সবাই উচ্চপদে আসীন।’
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে আন্দোলনকারীদের ‘অবমাননা করা হয়েছে’ দাবি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে স্লোগান দিতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগানের জেরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসাবাদ ও মোবাইল ফোন চেক করার ঘটনায় মুখোমুখি অবস্থান নেন আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের কর্মীরা। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীদের উপর আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এসময় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক লাবিব আহসানের মাথায় আঘাত করলে তিনি আহত হন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এরপর আন্দোলনকারীদের তোপের মুখে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হলের ভেতর চলে যান। পরে হলের ছাদে অবস্থান নিয়ে ইটের টুকরো ও ভাঙ্গা কাচের টুকরো নিক্ষেপ করতে থাকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এসময় ইটের আঘাতে আহত হন নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী সোহাগী সামিহা। এ ঘটনায় প্রভোস্টকে অভিযুক্ত করে পদত্যাগ দাবি করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
রবিবার (১৪ জুলাই) রাত সাড়ে ১১টায় ‘আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে’ এমন খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা এলাকায় জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। এরপর তারা একটি প্রতিবাদী মিছিল নিয়ে রবীন্দ্রনাথ হলের সামনে আসেন। এসময় শিক্ষার্থীরা হলের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করতে চাইলে ছাত্রলীগের সদস্যরা স্লোগান দিয়ে তাদের মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে প্রতিরোধ করে।
রবীন্দ্রনাথ হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এসময় আররাফি চৌধুরী ও তৌহিদুল ইসলাম তাকিদের নেতৃত্বে আন্দোলনকারীদের গতিরোধ করে দাঁড়ায়। ছাত্রলীগের সদস্যরা এসময় ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি’, ‘একটা দুইটা শিবির ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর’, ‘শিবিরের আস্তানা, ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও’ প্রভৃতি স্লোগান দিতে দেখা যায়।
অপরদিকে কোটা আন্দোলনকারীরা ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’; ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, রাষ্ট্র কারো বাপের না’, ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা, দেশটা কারো বাপের না’, ‘আমার ভাই আটক কেন, জবাব চাই’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে দেখা গেছে।
এসময় ঘটনাস্থলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আলমগীর কবির ও হল প্রভোস্ট অধ্যাপক নাজমুল তালুকদার উপস্থিত থাকলেও তাদের নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে।
এ ঘটনায় আন্দোলনকারীরা হল প্রভোস্ট অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদারের পদত্যাগের দাবি জানান। শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে হল প্রভোস্ট বলেন, ‘আমি হাতজোড় করে ক্ষমা চাই। তোমরা পদত্যাগ চাইলে এই মুহূর্তে পদত্যাগ করবো।’
ভোর ৪টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ হল এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে।