০৯/০২/২০২৫
“ভোম্বলের গ্রাম্য মসনদ”
রম্যরচনা
অরবিন্দ সরকার
বহরমপুর,মুর্শিদাবাদ।
ভোম্বল দাস লেখাপড়া শেখেনি, তালপাতার চাটাই বগলে নিয়ে স্কুলে যাওয়া, তারপর ধূলো কাদা মাখা পা পুকুরে ধুয়ে মাটিতে চাটাই পেতে বসে থাকা তার পছন্দ হয়নি। বাপের পাঁচ বিঘা জমি নিয়ে তার সংসারের ভরণপোষণ চলে। ভোম্বল জানে টাকা থাকলে বাঘের দুধ পাওয়া যায়। টাকার চিন্তায় তার ইচ্ছে হলো পঞ্চায়েত ভোটে প্রার্থী হয়ে প্রধান হবো।
সামনেই এপ্রিল মাসে পঞ্চায়েত ভোট, এখন জানুয়ারি মাস, হাতে সময় আছে তার। তবে টিকিট প্রাপ্তি এখনই ঠিক করে নিতে হবে। টাকায় প্রার্থীপদ,টাকায় ভোটে জেতা। তাছাড়া টাকা খরচা করে হারবার পাত্র ভোম্বল নয়! ভোম্বল গ্রামে প্রচার করলো,সে এবার প্রার্থী হতে চাই! সব দল একে একে তার বাড়িতে ভীড় করতে লাগলো। ভোম্বল জানে মিউ মিউ পার্টিতে সে যাবে না, আবার ঘেউ ঘেউ পার্টিতেও না! লাঠি যার জোর যার মুল্লুক তার,তাই সরকারী দলের কাছে বললো আমি বাঘ পার্টিতে দাঁড়াবো। বাঘ পার্টির নেতা মন্ত্রী তারা তার কাছে এলো, বললো প্রধান হতে লাগবে পাঁচ লক্ষ টাকা,আর সদস্য হতে লাগবে এক লক্ষ টাকা। তুমি কোনটা নেবে? জেতাবার দায় আমাদের, সব ভোটারের থেকে তোমাকে বেশী ভোট পাইয়ে দেবো। তাছাড়া এই টাকা পঁচাত্তর পঁচিশের ভাগে আমাদের মাত্র লাখখানেক টাকা জুটবে!
ভোম্বল বললো, তবে যেন হারামী কোরো না আমার সঙ্গে? এমনি তোমাদের সকলেই হারামখোর পার্টি বলে।
ভোম্বল তার সেরা এক বিঘা জমি পাঁচ লাখ টাকায় বিক্রি করে প্রার্থী পদে দাঁড়ালো। নির্দিষ্ট ভোটের দিনে বুকে ব্যাচ পরে হাতে লাঠি নিয়ে বুথের সামনে বসলো। পাড়ায় পাড়ায় সব লাঠিয়াল বাহিনী নেমে গেছে। কয়েকটি বোম ফাটানো হলো। বেশিরভাগ প্রার্থী দাঁড়াতেই পারেনি কিন্তু ভোম্বলের পাড়ার শত্রু সে ঘেউ ঘেউ দলে দাঁড়িয়েছে। সে একবার বুথে ঢুকে অফিসারদের সামনে নতজানু হয়ে ঘেউ ঘেউয়ে প্রতিবাদ করতে লাগলো। বুথে কোনো এজেন্ট নাই ভোম্বলের চারজন ছাড়া! এজেন্টরা ঘরের মধ্যে ওকে চপেটাঘাত শুরু করলো, বেরিয়ে ছুট লাগিয়ে পরবি তো পর ভোম্বলের সামনে। ভোম্বল বললো মার শালাকে? সঙ্গে সঙ্গে লাঠির মার পরলো গোটা শরীরে। হামাগুড়ি দিয়ে ওই প্রার্থী কোনোরকমে বাড়ি ফিরে দরজা বন্ধ করে দিলো। ভোম্বলের ভোটার সংখ্যা আটশো, ভোম্বল আটশো বাহান্ন ভোট পেয়ে জয়ী হলো। আবার নির্দিষ্ট দিনে বোর্ড গঠন হলো, ভোম্বল পেলো প্রধানের মসনদ। এপ্রিল মাস গরম কাল, মানুষের কাজ নেই। ঠিক এই সময়ে খাদ্যের বিনিময়ে কাজে পুকুর খননের পঞ্চাশ লক্ষ টাকা হাজির। গ্রামের গরীব মানুষ তারা ওই টাকায় কাজ চায়। ভোম্বল বললো স্কুলের সামনে পুকুর। ওটা খনন করলে জলে ডুবে ছেলে পুলে মরে যাবে তাই বলছি কি আমি দুর্গাপুজোর সময় কিছু টাকা দেবো আর বিসর্জনের দিন তোমাদের মদ দেবো।পেট পুরে খেয়ে আনন্দ করবে বেশ। কিছু লোক অসন্তোষ প্রকাশ করলে ভোম্বল বললো আমার ভালো জমি বিক্রি করে প্রধান হয়েছি,তাই আমি আগে সুদসমেত দশবিঘা জমি কিনি তারপর সব হবে উন্নয়ন।
সরকার খরা ঘোষণা করলো, টাকার ছয়লাপ পঞ্চায়েতে। ভোম্বল মেম্বারদের বললো দেখো পঁচাত্তর পঁচিশের ভাগ দিয়ে আমাদের ভাগাভাগি হবে। আমাদের আবার পঁচাত্তর পঁচিশের ভাগ হবে, পঁচাত্তর আমার আর বাদ বাকি তোমাদের ভাগ করে দেবো। মানুষের খুব দুর্দিন, দুর্দশা বেড়ে চলেছে, মানুষ জমি জমা ঘটি বাটি বেচতে শুরু করেছে, ভোম্বল সেগুলো বন্ধক রেখে সুদের মাধ্যমে তাদের টাকা ধার দিচ্ছে।
এদিকে ভোম্বল টাকা দিয়ে মাধ্যমিক পাশ করেছে, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করলো। তার স্ট্যাম্প বানিয়ে ফেলেছে। লোকে শংসাপত্র নিতে এলে ভোম্বল টিপসই দেওয়ায় জিজ্ঞেস করে স্যার সই করুন। ভোম্বল বললো – আমি পাকা কাজ করি,সই জাল করা যায় কিন্তু টিপছাপ কেউ জাল করতে পারবে না। দাঁড়া দেখবি সামনে বছর বি,এ পাশ করে এম এ পাশ করবো। তারপর ডক্টরেট ডিগ্রি নেবো। সময় ধর সব দেখতে পাবি। আমি আর ভোম্বল দাস থাকবোনা তখন ডঃ ভোম্বল দাস হবো। তারপর পদ্মশ্রী, ভারতরত্ন খেতাব নেবো, তারপর চেষ্টা করবো বিদেশি সম্মান নোবেল। তখন সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে ডিলিট,ফিলিট উপাধি দেবে। সবুরে মেওয়া ফলে, তোরা দেখে যা। তখন তোদের গর্ব হবে আমাকে নিয়ে! গ্রামে আমার মূর্তি তৈরি হবে,শহরের পথের নাম হবে আমাকে নিয়ে। তাই তোমরা শুধু দেখে যাও, কিভাবে দেশ ও দশে আমার সুখ্যাতি। এরপর এম,এল,এ,এম,পি হবো। হয়তো দেখবে কবে রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধান মন্ত্রী হয়ে যাবো। এসবের বয়েসের মাপকাঠি নাই, শুধুমাত্র চাকুরীর সময়সীমা আছে, আবার অবসর আছে। আর আমাদের অবসর নেই। মানুষের সেবায় নিয়োজিত আমাদের মনপ্রাণ। কেনারাম বেচারাম, হাবিজাবি ববি যদি মন্ত্রী হয় তাহলে আমি কেন হবো না। লক্ষ্য স্থির থাকলে,আর মা মনসার মন্ত্র জানলে বিষ ঝেড়ে ফেলে দেওয়া যায়। দেখি এবার আমার নামের ডিগ্রি ফলক তৈরি করে তোমাদের শংসাপত্র দেবো কিন্তু আমার প্যাডে বুড়ো আঙুল লেপ্টে তোমাদের খাতায় চেপ্টে দেবো। টালির বাড়ি কি চিরদিন থাকবে তাই পাঁচ তলা প্রাসাদ বানালাম কতো শ্রমিককে কাজ দিয়ে। এবার শিল্প কারখানা হবে, তখন দেখবে কতো শিল্প আসবে যাবে। শিল্প সম্মেলন হতে শুধু দেরী। চপ বেগুনি,শিল্পে কতো শিক্ষিত বেকারের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। আদালতের কাছে বা মানুষের কাছে ঘাড় ধাক্কা খাওয়াও একটি শিল্প বা কায়দা। এসব তোমাদের বুঝতে সময় লাগবে! এসব ফিল্মি কায়দা। ভালো পাকা অভিনেত্রী হলে তবেই নায়ক পাওয়া যায়।
—————————-