মনের ভালোবাসা প্রায়শই দুনিয়ার মোহ ও আকাঙ্ক্ষায় আবদ্ধ। এটি বাহ্যিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়, প্রশংসার আশায় তৃষ্ণার্ত থাকে। মনের প্রেম সহজেই ভেঙে পড়ে, ক্ষণিকের বিরহেই শূন্যতায় ডুবে যায়। এটি আঘাতে আহত হয়, প্রত্যাশার ভারে নুইয়ে পড়ে। এই ভালোবাসা যেমন দ্রুত আসে, তেমনি দ্রুত হারিয়েও যায়, যেন মরুভূমির বুকে বয়ে যাওয়া এক ক্ষণস্থায়ী বায়ু।
কিন্তু আত্মার ভালোবাসা ভিন্ন। এটি এক নিঃশব্দ নুরানী আলো, যা আল্লাহর মহব্বত থেকে উদ্ভাসিত। এই ভালোবাসায় কোনো চাহিদা নেই, নেই কোনো প্রতিদানের আশাও। এটি নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার এক অনির্বচনীয় আনন্দ, ত্যাগে শান্তি খোঁজার এক মুগ্ধতা। আত্মার ভালোবাসা এমন এক নিরন্তর স্রোত, যা আল্লাহর ইচ্ছায় প্রবাহিত হয়, তার ফয়সালায় তৃপ্ত থাকে।
আল-কুরআনে বলা হয়েছে,
"আর যারা ঈমান এনেছে, তাদের ভালোবাসা আল্লাহর জন্যই সর্বাধিক।" (সুরা আল-বাকারা ১৬৫)
আত্মার এই ভালোবাসায় আল্লাহর সৃষ্টির প্রতিটি কণায় তার সত্তার ছোঁয়া পাওয়া যায়। এটি কেবল ইবাদত-বন্দেগির মাঝে সীমাবদ্ধ নয়, বরং জীবনের প্রতিটি কাজে, প্রতিটি চিন্তায় আল্লাহর স্মরণ জড়িয়ে থাকে। একজন আশেক (প্রেমিক) যেমন তার প্রিয়জনের চাওয়াতে নিজেকে বিলিয়ে দেয়, তেমনি আত্মার প্রেমিক আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের সমস্ত ইচ্ছাকে তার ইচ্ছার সঙ্গে মিলিয়ে দেয়।
এই ভালোবাসা এমন, যেখানে বান্দা তার রবের ইচ্ছার সামনে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে। যেমন নদী সমস্ত বাঁক পেরিয়ে অবশেষে সমুদ্রে মিশে যায়, তেমনি আত্মার ভালোবাসা আল্লাহর সান্নিধ্যে নিজেকে বিলীন করে। এটি জানে, জীবনের প্রতিটি পরীক্ষায়, প্রতিটি কষ্টে আল্লাহর রহমত লুকিয়ে আছে।
রবের প্রতি প্রকৃত ভালোবাসায় থাকে তাওয়াক্কুল (পূর্ণ নির্ভরতা), থাকে রিদা বিল কদর (আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকা)। এই প্রেমে বিরহ মানে আল্লাহর আরও নৈকট্য লাভ, কষ্ট মানে আত্মার শুদ্ধি, নীরবতা মানে আল্লাহর সাথে নিঃশব্দ কথোপকথন।
যেমন হজরত আইয়ুব আ. দীর্ঘ রোগভোগেও আল্লাহর রহমতের উপর পূর্ণ আস্থা রেখেছিলেন, তেমনি আত্মার ভালোবাসায় সকল বিপদই আল্লাহর কাছে আরও নত হওয়ার একটি সুযোগ। এই প্রেমে নিজেকে আল্লাহর ইচ্ছায় ছেড়ে দেওয়া হয়, তাওয়াক্কুলের প্রশান্তিতে ডুবে থাকা হয়।
আত্মার ভালোবাসা যখন পূর্ণতা পায়, তখন দুনিয়ার মোহ আর স্পর্শ করে না। এটি আখিরাতের (পরকাল) দিকে এমনভাবে ধাবিত হয়, যেমন একটি পরিযায়ী পাখি তার চিরচেনা আকাশের পথে উড়ে চলে মুক্ত, নির্ভীক, আর রবের সান্নিধ্যের আশায় উচ্ছ্বসিত।
এই প্রেম আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি মমতা জাগায়, মানুষের প্রতি খালেস মহব্বত আনয়ন করে।
রাসুলুল্লাহ সা.বলেছেন:
"যে আল্লাহর জন্য ভালোবাসে এবং আল্লাহর জন্যই ঘৃণা করে, সে তার ঈমান পূর্ণ করল।"(সুনানে আবু দাউদ: ৪৬৮১)
এখানে প্রতিটি সম্পর্কই আল্লাহর সন্তুষ্টির মাধ্যম, প্রতিটি ভালোবাসাই রবের নৈকট্য অর্জনের সোপান। বান্দার হৃদয় থেকে যখন সমস্ত পর্দা সরে যায়, আল্লাহর নূর যখন তার অন্তরে প্রতিফলিত হয়, তখন আত্মার প্রেমিক রবের প্রেমেই সন্তুষ্ট থাকে।
আল্লাহর প্রতি প্রকৃত ভালোবাসায় বান্দা তার সমস্ত আশা-ভরসা, সকল ইচ্ছা এবং সমস্ত আকাঙ্ক্ষা আল্লাহর হাতে সমর্পণ করে। সে জানে, আল্লাহ যা করেন, তাতেই কল্যাণ। জীবনের প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি পরীক্ষায় সে আল্লাহর হিকমত (প্রজ্ঞা) খুঁজে পায়।
প্রকৃত ভালোবাসা সেই, যা দুনিয়ার মায়ার বাঁধন ছাড়িয়ে আখিরাতের আলোর পথে নিয়ে যায়। এটি বান্দাকে ইবাদতে মগ্ন রাখে, সেজদায় কান্নায় ভিজিয়ে দেয়, রাতের নীরবতায় রবের সঙ্গে নিঃশব্দ কথোপকথনে ডুবিয়ে রাখে।
এই ভালোবাসা কেবল অনুভবে নয়, বরং জীবনের প্রতিটি কাজে, প্রতিটি চিন্তায়, প্রতিটি দোয়ায় প্রতিফলিত হয়। এটি বান্দাকে এই দুনিয়ায় শান্তি দেয় এবং আখিরাতে জান্নাতের পথে নিয়ে যায়।
ভালোবাসার প্রতিটি স্পন্দনে আল্লাহর নাম থাকে, আত্মার প্রতিটি প্রশান্তিতে তার সান্নিধ্যের আলো জ্বলে। এ ভালোবাসাই প্রকৃত, যা দুনিয়ার নয়, বরং আখিরাতের সফলতার পথে আলোকিত করে।
এটাই প্রকৃত ভালোবাসা, যা শুধু মনের নয়, আত্মারও সমর্পণ, যা রবের নূরে আলোকিত, যা দুনিয়ার মোহ ছেড়ে আখিরাতের প্রশান্তি খুঁজে পায়।
শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর