জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ানঃ সকালটা আজ যেন অভিমানী। সূর্যের আলো উঠেছে ঠিকই, কিন্তু তার রঙে নেই কোনো উষ্ণতা। যেন আমিও চলে যাওয়ার আগে তাকে জানিয়ে দিয়েছি—আজ আমার অন্তরে আলো নেই, শুধুই কুয়াশা।
আজ আমি পাড়ি দিচ্ছি দূর দেশের পথে। হাতে পাসপোর্ট, মনে দুঃসাহস, আর চোখে মায়ের মুখ।
ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় মা চুপচাপ দাঁড়িয়ে। চোখে ক্লান্তি, ঠোঁটে কোনো শব্দ নেই, কিন্তু তার নিঃশ্বাস কাঁপছে। বুঝতে পারি, কতটা কিছু সে আটকে রেখেছে নিজের বুকের ভেতর।
শেষ মুহূর্তে কেবল বলল,
“তুই চলে যা বাবা, তবে তোকে আল্লাহর জিম্মায় দিলাম।”
এই শব্দগুলো যেন কোনো দোয়ার পরশ। এই বাক্যে ছিল নাড়িছেঁড়া ভালোবাসার আশ্রয়, ছিল আত্মসমর্পণের ঈমানি শক্তি। আমি কোনো উত্তর দিতে পারিনি। শুধু মায়ের গায়ে মুখ রেখে চুপচাপ ভিজিয়ে দিয়েছিলাম তার ওড়নার কিনারা।
তার বুকের স্পর্শ, কপালে রাখা হাতের দোয়া, কাঁধে জড়িয়ে রাখা সেই নিশ্চিন্ত আশ্রয়—সবকিছু মিলিয়ে আমি বুঝে গিয়েছিলাম, এই বিদায় কেবল দূরত্বের নয়, এ এক আত্মা কেঁপে ওঠা মুহূর্ত।
গাড়িতে ওঠার সময় পেছন ফিরে দেখি, মা দাঁড়িয়ে আছে নীরব বাতাসের মতো। কোনো শব্দ নেই, তবু সেই চাহনি বলছে হাজার কথা। চোখ দিয়ে ঝরে পড়ছে অশ্রু, কিন্তু তার ঠোঁটে আবারো সেই বাক্য,
“আল্লাহ তোকে হেফাজত করবেন।”
এই কথাটাই আমি বুকের ভেতর রাখি। হাজার মাইল দূরে থেকেও প্রতিটি ঝুঁকির মুহূর্তে মনে হয়, মা যেন দূর থেকে আমার কপালে হাত রাখছে। তার দোয়া যেন বাতাসে ভেসে এসে আমাকে ঘিরে রাখে।
প্রবাসে অনেক কিছু পাওয়া যায়—ক্যারিয়ার গঠনের মাধ্যম, সাফল্য, একাকীত্ব।
কিন্তু মায়ের সেই এক কাপ চায়ের আহ্বান, নামাজের পর দোয়ায় আমার নাম উচ্চারণ, রাতে দরজার ফাঁকে মুখ বাড়িয়ে দেখা, এসবের কোনো বিকল্প নেই।
তবুও আমি যাচ্ছি। কারণ মা আমায় শিখিয়েছে,
“জীবন মানে ত্যাগ, মানে দায়িত্ব। আর দায়িত্ব মানেই আল্লাহর ওপর ভরসা।”
আজ সেই ভরসা নিয়েই যাত্রা শুরু করলাম, মায়ের চোখে রেখে গেলাম আমার সমস্ত ভালোবাসা। তার দোয়ার মতো বিশুদ্ধ কোনো ছায়া নেই পৃথিবীতে। সেই দোয়ার বরকতেই, আমি জানি, প্রতিটি পথ আলোকিত হবে।
আর, আমি একদিন ঠিকই ফিরব—
মায়ের কোলে , সেই পরিচিত উঠোনে, যেখানে ভালোবাসা শব্দের অপেক্ষা করে না, শুধু চোখে চোখ রাখলেই বোঝা যায়,
“তুই আমার সন্তান, তুই আমার দোয়ার চিরন্তন নাম।”
লেখক, শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো,মিশর