লেখক জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ানঃ সে ছিল স্বপ্নবতী এক তরুণী—চেহারায় মাধুর্য, মননে দীপ্তি। চোখে ছিল স্বপ্ন, হৃদয়ে ছিল নির্মল আকাঙ্ক্ষা। আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পড়ার সময় একদিন স্বাভাবিকভাবেই বাবার কাছে বিয়ের কথা তুলেছিল সে। নারীত্বে পা রাখা কিশোরীর হৃদয়ে যে স্বপ্ন জন্ম নেয়, সেটিই শুধু একটু প্রকাশ পেয়েছিল।
কিন্তু বাবার কণ্ঠে বজ্রধ্বনি,
“আগে পড়াশোনা শেষ করো। অন্য কথা পরে ভাবা যাবে।”
বাবার আদেশ অমান্য করার মতো দুঃসাহস কিংবা ইচ্ছা—কোনোটিই ছিল না তার। তিনি ছিলেন বাবার একনিষ্ঠ, অনুগত কন্যা। তাই আবেগের পাপড়ি মুড়িয়ে গুটিয়ে নিলেন স্বপ্নগুলোকে, মুঠো করে ধরলেন শিক্ষা আর আত্মউন্নয়নের দিশা।
সময় গড়ালো। পোস্টগ্র্যাজুয়েট শেষ করলেন, তারপর পিএইচডি। জ্ঞানের সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলেন সম্মানিত উচ্চতায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হলেন, শিক্ষকতা পেলেন গৌরবের আসনে। কিন্তু হৃদয়ের গহীনে জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস প্রতিদিন একটু করে ভারি হতে থাকল।
সেই সময় তাঁর জন্য একাধিক বিয়ের প্রস্তাব এল। সহকর্মী কিংবা শুভানুধ্যায়ীরা প্রস্তাব রাখলে, বাবার সাড়া একটাই,
“না।”
ছেলেটির চেহারা ভালো না, কারও আয় কম, কারও আবার পারিবারিক পটভূমি পছন্দ নয়। মেয়ের জন্য তিনি খুঁজছিলেন ‘নিখুঁত’ কাউকে—যিনি বাস্তবে কখনোই ছিলেন না। বাবা ভুলে গিয়েছিলেন, এই দুনিয়ায় কেউই নিখুঁত নয়। এমনকি তাঁর মেয়েও না।
বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। যে মেয়েটি এক সময় প্রাণবন্ত ছিল, সেই আজ নিঃসঙ্গতার নিঃশব্দ ঘরে বন্দি। হৃদয়ে জন্ম নিয়েছে বিষণ্নতা, বিষাদ। ডিপ্রেশন হয়ে দাঁড়ায় তার অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী।
একদিন সামান্য অসুস্থতা তাকে হাসপাতালে নেয়। সেখান থেকেই তার জীবনের শেষ অধ্যায় শুরু হয়। শেষ মুহূর্তে বাবাকে ডেকে বললেন—
“বাবা, বলুন আমিন।”
“আমিন।”
“আবার বলুন আমিন।”
“আমিন।”
“আরও একবার বলুন আমিন।”
“আমিন।”
তারপর কণ্ঠে বিষণ্ন দাহ নিয়ে বললেন:
“ওয়াল্লাহি! আল্লাহর কসম! আল্লাহ যেন আপনাকে আখিরাতে জান্নাতের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেন, যেভাবে আপনি আমার যৌবনে আমাকে বিয়ের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেছেন।”
আকাশ যেন থমকে দাঁড়াল। বাতাস থেমে গেল এক মুহূর্ত। একজন কন্যার বুকভাঙা অভিশাপ—যে তার বাবার কাছেই স্বপ্ন জমা রেখেছিল, ভালোবাসা খুঁজেছিল।
এই গল্পটি কেবল একজন নারীর নয়।
এ আমাদের সমাজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া একটি বাস্তবতা। এখনো বহু মেয়ের জীবন এমনভাবে ঝরে যায়, যারা ‘উচ্চমানের পাত্র’ পাওয়ার প্রতীক্ষায় তাদের যৌবনের সর্বোত্তম সময়টুকু বিসর্জন দেন। তারা রাজপ্রাসাদ চায় না, চায় না ধনরত্নে ভরা রাজপুত্র—শুধু চায় একটু সহানুভূতি, ভালোবাসা আর নিরাপত্তার আশ্রয়।
সময়ের প্রতি উদাসীনতা, বাবা-মায়ের অতিরিক্ত প্রত্যাশা আর ভুল সিদ্ধান্ত— সব মিলিয়ে মেয়েটির জীবনে রয়ে যায় নিঃসঙ্গতার দীর্ঘশ্বাস।
মা-বাবাদের প্রতি বিনীত আহ্বান,
সময়মতো বিয়ে কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি জীবনের ভারসাম্য রক্ষার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
অন্যথায়, সেই অভিশাপের ভার হয়তো শুধু এ দুনিয়ায় নয়—আখিরাতেও বইতে হবে।
লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী, ফ্যাকাল্টি অব থিওলজি, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিসর
যোগাযোগ
✆ +201503184718