❝মলিন বিষাদ❞
সারা জাহান মাইরা রচিত –
— ভূমিকা
জীবনের এক সন্ধ্যায় হঠাৎই মেয়ের মুখে শোনা এক প্রশ্ন ইয়াসমিন শেখের হৃদয়ে ঝড় তোলে —
“মা, তোমার কি আগের দিনগুলোতে ফিরে যেতে মন চায় না?”
সেই প্রশ্ন যেনো এক দরজা খুলে দিলো, যেখান থেকে বেরিয়ে এলো ভুলে থাকা এক ভালোবাসা, অদ্ভুত এক সিদ্ধান্ত, আর কিছু না বলা স্বপ্নভঙ্গের কাহিনী। কেনো ইয়াসমিন শেখ এত ব্যথিত? মেয়ের কথা কেনো তাকে ভিতরে ভিতরে ভেঙে দিলো? আর কে সেই রহস্যময় ‘নূর’, যার এক চাহনিতে বদলে গিয়েছিলো ইয়াসমিনের জীবন?
একটা সংসারের দায়, প্রেম-ভালোবাসা, স্বপ্ন ও বাধ্যবাধকতার টানাপোড়েন—সব মিলে এক বাস্তবধর্মী গল্প।
শুরু হচ্ছে — “ইয়াসমিন শেখের জীবনের অজানা অধ্যায়”…
খুব উদগ্রীব লাগছে আজ তাকে। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব থেকে অসুখী মানুষটা বোধহয় সে। পুরোনো ব্যথারা আজ নতুন করে কড়া নাড়ছে মনের দরজায়। আজ ইয়াসমিন শেখ যেনো নতুন করে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো। মেয়ের একটি কথা যেনো তার কানে তীরের মতো লাগলো। ভুল তো কিছু বলেনি তারা সত্যি ভিন্ন রকম জীবন পেতে পারতো। কিছুক্ষণ আগেই মেয়ে ফাহমিদা তার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছিলো। আশাতীত ভাবে আজ জিজ্ঞেস করলো –
” মা, তোমার কি পুরোনো দিন গুলোতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না? ”
ইয়াসমিন শেখ মৃদু হেসে বললো –
” কোন দিনগুলো মা? ”
ফাহমিদা তার ব্যস্ত হাত থামিয়ে বললো-
” সেই দিনগুলো মা, যেই দিনগুলোতে তোমার আঙুল ধরে ঘুরে বেরাতাম।তুমি যখন জমিতে ধান বুনতে আমি একটু দূরে বসে তা দেখতাম। যখন তুমি ধান উড়ানোর সময় মজার ছলে আমার দিকে ধান ছুরে মারতে। সেই দিনগুলোতে মা, যখন তুমি আর আমি এক সাথে শাক তুলতে যেতাম। বকুল ফুল গাছের নিচে বসে গল্প করতাম। বিকেল হলে তোমার সই হয়ে ঘুরে বেরাতাম। মা, সেই দিন গুলো কি আর ফিরে পাবো না? ”
ইয়াসমিন শেখ নিশ্চুপ। সে কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। সে যেনো আজ জীবনের কুল কিনারা হারিয়ে ফেলছে নতুন করে। ফাহমিদা তো এমন কথা বলার মেয়ে নয়। তাহলে আজ কেনো এসব বলছে? মা-কে পুরাতে বুঝি? নাকি আজ তার সত্যি ইচ্ছে হচ্ছে পুরোনো দিন গুলোতে ফিরে যেতে? ফাহমিদা মায়ের পাশ ছেড়ে উঠে পড়েছে। রুম থেকে যেতে যেতে বলে গেলো –
” থাক বাদ দাও মা। এসব বলা আর মানায় না ”
ফাহমিদা হনহনিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। দরজার ওপাশে ছোট বোন কিরনকে দেখলো দাড়িয়ে আছে। এক নজর পরখ করে চলে গেলো। কিরন মা-কে একবার আড়াল থেকে দেখে চলে গেলো। মায়ের মুখটা কেমন মলিন বিষাদ দেখাচ্ছে।আজও কি মা কাঁদবেন দরজা লাগিয়ে? হয়তো কাঁদবেন।
ইয়াসমিন শেখ বিছানায় শুয়ে পড়লেন। আজ তার মনে নতুন করে জোয়ার এসেছে তাকে ভেঙে দিতে। চোখ বন্ধ করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠে পুরোনো দিনের স্মৃতিগুলো।
হেসেখেলে ইয়াসমিন স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরছে। অদূরে দাঁড়িয়ে এক জোরা চোখ তাকে দেখছে। ইয়াসমিনের অবশ্য সেদিকে খেয়াল নেই। সে আপন মনে সই রুপসির হাত ধরে হেটে চলেছে। বাড়িতে পা রাখতেই কানে ভেসে আসে মা রহিমা শেখ-এর চিল্লাচিল্লি। রহিমা শেখ-এর এটা নিত্য দিনের অভ্যাস। কারনে-অকারনে সে চিল্লাবে। কখনো মেয়ের উপর কখনো দুই ছেলের উপর। আবার কখনো স্বামীর উপর। ইয়াসমিন-এর বাবা রাসেদ শেখ, বাবুর্চির কাজ করেন। গ্রামে কারো বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে মানেই রাসেদ শেখ-এর ডাক পড়বে। রাসেদ শেখ-এর রান্নার সুনাম আশেপাশের দশ গ্রামের সবার মুখেই সোনা যায়। ইয়াসমিনের বড় ভাই শফিক গঞ্জে মুদির দোকানে কাজ করে। মাধ্যমিক দেওয়ার পর আর পড়ার সুযোগ হয়নি তার, অর্থের অভাবে। আর ছোট ভাই মুনিব, সে কোনো মতে ঠেলে-ধাক্কায় তৃতীয় শ্রেণীর বারান্দা দেখেছে। এরপর আর পড়াশোনা করেনি সে। উড়নচণ্ডী হওয়ায় পড়ায় তার মন বসে না। সারাক্ষণ উড়ে বেড়ানোই তার কাজ। ইয়াসমিন মায়ের চিল্লাচিল্লিতে ভ্রুক্ষেপ না করে চলে গেলেন বারান্দায় বসে থাকা বাবা রাসেদ শেখ-এর কাছে।কাধের ভারি ব্যাগটা রাখতে রাখতে বললো –
” পুরো নানির স্বভাব পেয়েছে। কোথা থেকে যে এনেছিলে আমাদের মা-কে, কে জানে ”
মেয়ের কথাতে রাসেদ শেখ ক্ষানিকটা হাসলেন। অতঃপর মেয়েকে বললেন –
” যা মা, কাপড় পাল্টাইয়া নে। স্কুল থিকা আইছোস। আগে কয়ডা খা, তারপর তোর মায়ের কিচ্ছা কোলাপ হুনমুনি ”
ইয়াসমিন আর কথা বারালো না। সে চলে গেলো বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর পাড়ে। গোসল করে বাড়ির উঠানে পা রাখতেই সে কিছুটা ভেবাচেকা খেয়ে গেলো। স্কুলের সামনে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটা তাদের বাড়ির উঠানে বসে আছে। দৃঢ় দৃষ্টি মেলে বুঝতে চাইছে ছেলেটা কেনো এসেছে। হঠাৎ ছেলেটার পাশে বসা মাঝ বয়সের লোকটা বলে উঠলো –
” চাচা সাহেব, আপনার মাইয়ারে আমার শালার ভাল্লাগছে। আপনার মাইয়ারে বউ বানাইতে চায় ”
রাসেদ শেখ কিছুটা ভেবে বললেন –
” তা ঠিক আছে। কিন্তু এমনে তো আর বিয়া দেওয়া যায় না। দেখা সাক্ষাত এর একটা ব্যাপার আছে। পোলার বাপরে নিয়া আহেন। তারপর আমরা বিয়ার কথা কমু ”
লোকটা কিছুটা ভ্রু কুচকালো। মনে হচ্ছে কথাটা তার পছন্দ হয়নি। সে চায় তার শালার বিয়ে একা করাতে অথচ এর মাঝে কি না তার শ্বশুরকে জড়াতে হবে। ইশতিয়াক সাহেব ক্ষীণ হেসে জানান দিলেন –
” চাচা সাহেব, বিয়েটা নূর একাই করতে চায়। ওর অভিবাবক হিসেবে আমি আর ওর বড় বোন উপস্থিত থাকমু। আমার শ্বশুরের মত নাই এই বিয়ায় কিন্তু আমার শালা নূর আপনার মাইয়ারে এক দেখায় ভালোবাইসা ফালাইছে। তাই আর না করবেন না চাচা ”
ইয়াসমিন কাঙ্খিত ছেলেটার নাম এবার জানলো। উদ্দেশ্যটাও জানলো। কেনো সে এসেছে এখানে। তাহলে পাশের মাঝ বয়সি লোকটা তার বোন জামাই। অর্থাৎ নূরের দুলাভাই। ইয়াসমিন তাদের আলাপচারিতা শুনে নূরের দিকে দৃষ্টি ফেলে একবার তাকে পরখ করে নিলো। মাথায় এক ঝাক কোঁকড়া চুল। শ্যাম বর্ণের ছেলেটাকে শহুরে পোশাকে বেশ লাগছে। হাতে একটা কালো ফিতার ঘড়ি। ইয়াসমিন চোখ সরিয়ে নিলো। এই ভয়ে যদি মনের মনিকোঠায় জায়গা দিয়ে ফেলে নিজের অজান্তে। বয়সটাই তো এখন এমনই। চোখে কাঠের চশমার জায়গায় রংধনুর রঙিন চশমা পড়ে থাকে। এই হলো কিশোরী বয়সের এক ঝামেলা। মন তখন মানা শোনেনা শুধুই উড়তে চায়।
ইয়াসমিন ভেংচি কাটলো। মনে মনে তাচ্ছিল্য করতেও ভুললো না। নূর ছেলেটা দেখতে এতোটাও খারাপ নয়। তবুও ইয়াসমিন ঘরের ভেতরে গিয়ে হাত নাচিয়ে একা একা বলতে শুরু করলো –
” ইশ! বর এসেছে আমায় বিয়ে করতে। দেখতে লাগে কাচা কুনচির মতো আর চোখ দু’টো তো একদম খাটাসের চোখের মতো। মাথার গুলো? যেনো চুল নয় সাইলির মা’র বাশ বাগান। বেটা আক্কাস আলী যেনো কোথাকার”
এখন এতো বদনাম করছে ঠিকই তবে একটু আগে নূরকে দেখে ইয়াসমিন থমকে গিয়েছিলো।হারিয়ে গিয়েছিলো এক কল্পনার রাজ্যে। নিজের মন দিয়ে দিয়েছে নূরকে। এসব কিছু যেনো তার অজ্ঞাত। বাঙালী নারী বলে কথা। এরা কখনোই নিজের অনুভূতি টের পায় না।
রাসেদ শেখ ভাবুক হয়ে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। নূর এবং তার দুলাভাই ইশতিয়াক সাহেব রাসেদ শেখ-এর উত্তরের আশায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ ভেবে রাসেদ শেখ বললেন –
” ঠিক আছে। আমি রাজি ”
হাসির দেখা মিললো নূরের মুখে।সে এতোক্ষণ উসখুস করছিলো। তার মন অস্থির হয়ে ছিলো। ক্ষানিকটা ঘামতেও শুরু করছিলোও বটে। যদি পছন্দের মানুষটাকে না পায়? এই ভয়ে মুখের হাসিটাও মলিন হয়ে ছিলো। তবে রাসেদ শেখ-এর কথাতে নূর যেনো এবার প্রাণ ফিরে পায়। চোখ দু’টো রসগোল্লার মতো উজ্জল হয়ে উঠে। খুশিতে গদগদ হয়ে যায় নূর।
ইশতিয়াক সাহেব নূরের পিঠ চাপড়ে বললো-
” শালা তোর কপাল খুইল্লা গেছে। চল বাড়ি চল জামাই সাজার প্রস্তুতি নে”
এরপর রাসেদ শেখ-এর দিকে তাকিয়ে হাসি মাখা মুখে ইশতিয়াক সাহেব বলল-
” তাইলে চাচা, বিয়ার কামডা কাইলকাই সাইরা ফালাই? ”
রাসেদ শেখ একটু অবাক হলেন। বিয়ে তো হবেই, কিন্তু এতো তারাহুরার কি আছে? একটু সময় নিয়ে বিয়েটা হলে কি এমন ক্ষতি হবে? বিয়ে-সাদির ব্যাপার একটু তো সময় নেওয়া দরকার। সবকিছুতে কি তারাহুরা চলে নাকি? এতো সব প্রশ্ন মাথায় রেখে রাসেদ শেখ বললেন –
” এতো তারাহুরার কি আছে? ক্ষানিক সময় নেi আমরা? ”
” চাচা শুভ কাম আগে ভাগেই সাইরা ফালানো ভালো। আপনে আর দ্বি-মত প্রকাশ কইরেন না ”
রাসেদ শেখও আর কথা বাড়ালো না। সে রাজি হয়ে গেলো।রাজি হবেই বা না কেনো..টানাটানির সংসার আর মাইয়া মানুষ তারাতাড়ি বিয়ে দেয়াই ভালো। এক মাত্র মেয়ে তার এতো বড় ঘরে বিয়ে হচ্ছে দ্বি-মত না করাই ভালো।যদি এতো ভালো ছেলে হাত ছাড়া হয়ে যায়। সেই ভয়ে আর সে দ্বি-মত প্রকাশ করলো না। মল্লিক বাড়ির মেঝো বউ হতে যাচ্ছে তার এক মাত্র মেয়ে ইয়াসমিন। গৃহস্থ বাড়ি তাছাড়াও নূরদের গঞ্জে আড়তে কাচা মালের ব্যবসাও আছে। নেহাত মেয়েটার কপাল ভালো। এই জন্যই মল্লিক পরিবারের সদস্য হতে পারছে। তবে মনের মধ্যে একটু একটু ভয়ও লাগছে রাসেদ শেখ-এর। হিতে বিপরীত না হয়ে যায় সব। রাসেদ শেখ তাদের বিদায় দিয়ে ঘরে গিয়ে দেখলো ইয়াসমিন এই মাথা থেকে ঐ মাথা পাইচারি করছে। আর কি জেনো বির বির করে বলছে সে।
” কিরে মা, কি কথা কস একা একা? ”
চোকিতে বসতে বসতে কথাটি বললন রাসেদ শেখ। ইয়াসমিন বাবার কথাতে হকচকিয়ে উঠলো । বাবার পাশে এসে বসলো। বাবাকে জিজ্ঞেস করলো-
” বাবা কি কথা হলো?”
পাশ থেকে রহিমা শেখও একই কথা বললেন। রাসেদ শেখ মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলল-
” কাল তোর বিয়া মা। প্রস্তুতি নে যা ”
ইয়াসমিন ধপ করে বাবার পাশ থেকে উঠে পড়লো। বাবা কি বলছে এসব? সে তো এখনো পড়াশোনা শেষ করেনি তাহলে এখনি কেনো বিয়ে? সে তো পড়াশোনা করতে চায়। জীবনে অনেক বড় হতে চায়। সে এখনি বিয়ে করতে চায় না।
ইয়াসমিনের বিয়ের খবরে সব থেকে বেশি খুশি হলো রহিমা শেখ। এই অভাবের সংসারে পাঁচটা মানুষের খরচ বহন করতে রাসেদ শেখ রীতি মতো হিমশিম খেয়ে উঠে। বড় ছেলে আয় করলেও সেই স্বল্প আয়ে সংসার ঠিকঠাক চলে না। মেয়েটার বিয়ে হলে যেনো হাপ ছেড়ে বাঁচে।
পর্ব সংখ্যা – ০১