সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলে প্রতি বছর প্রায় ৭০% এলাকা পানিতে প্লাবিত হয়, যার ফলে পরিবার পরিকল্পনা, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা কার্যক্রমে বড় ধরণের বিঘ্ন ঘটে। BDHS (২০২২) অনুযায়ী, এই জেলায় ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ৬০% এর বেশি ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই বিবাহিত হয়েছেন। অপরদিকে, দূষিত পানি ও অপর্যাপ্ত স্যানিটেশনের কারণে কিশোরীদের মধ্যে ৩৫% এরও বেশি অনিয়মিত মাসিক ও ইউরিন ইনফেকশনের সমস্যায় ভোগেন (Global Health Now, 2024)। বর্ষাকালে বহু পরিবার স্বাস্থ্যসেবা নিতে একমাত্র বিকল্প হিসেবে নৌকা ব্যবহার করে থাকেন, যা জরুরী সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা, বিশেষ করে কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার নিশ্চিত করার পথকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করছে।
এই বাস্তবতা সামনে রেখেই তরুণদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার (SRHR) ও জলবায়ু সহনশীলতা ইস্যুতে নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সরাসরি সংলাপের সুযোগ করে দিতে ৭ আগস্ট জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়, সুনামগঞ্জে অনুষ্ঠিত হলো একটি দিনব্যাপী নীতিগত সংলাপ কর্মশালা। ইউএনএফপিএ-বাংলাদেশ এর সহায়তায়, সুইডিশ উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থা সিডা’র অর্থায়নে এবং সিরাক-বাংলাদেশ এর বাস্তবায়নে ‘ইয়ুথ ক্যাটালিস্ট’ প্রকল্পের আওতায় এই কর্মশালাটি অনুষ্ঠিত হয়। প্রকল্পটি বিশেষভাবে প্রান্তিক ও জলবায়ু-সংবেদনশীল তরুণ জনগোষ্ঠীর প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা ও জলবায়ু সহনশীলতা সংশ্লিষ্ট জাতীয় নীতিমালায় পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে কাজ করবে। জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ের তরুণদের সাথে পরামর্শমূলক সভা, কর্মশালা, ক্যাম্পেইন এবং অন্যান্য কার্যক্রম সমূহের মাধ্যমে যুবদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা বিষয়ক একটি জাতীয় শ্বেতপত্র তৈরি করে সংশ্লিষ্ট জাতীয় নীতিমালায় পরিবর্তন আনাই এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য।
এই কর্মশালায় সুনামগঞ্জ জেলার বিভিন্ন সামাজিক ও ভৈৗগলিক অবস্থান থেকে ৩০ জন তরুণ প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন, যারা তাঁদের নিজ নিজ বাস্তব অভিজ্ঞতা, অঞ্চলভিত্তিক সংকট এবং নীতিগত প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন। তাদের আলোচনার মূল বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল: মাসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা, দুর্যোগকালে স্বাস্থ্যসেবায় বিঘ্নতা, জলবায়ুজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি, প্রতিবন্ধী ও প্রান্তিক তরুণদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার (SRHR), সেবা প্রাপ্তি।
উদ্বোধনী বক্তব্যে সিরাক-বাংলাদেশ এর নির্বাহী পরিচালক এস এম সৈকত বলেন: “সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চল প্লাবিত হওয়ার ফলে যে সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে সাথে স্বাস্থ্যসেবার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হয়, তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে। কিশোর-কিশোরীরা অনেকেই এখনো কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যকেন্দ্র সম্পর্কে জানে না, এমনকি সেখানকার সেবাসমূহ সম্পর্কেও অবগত নয়। আমরা যে কাঙ্ক্ষিত বৈষম্যহীন পরিবর্তনের কথা বলি, সেই পরিবর্তন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ খাতে তরুণদের অভিগম্যতার মাধ্যমেই শুরু হওয়া উচিত। কারণ, আমরা এমন একটি সময় পার করছি যেখানে দেশের যুব জনসংখ্যা সর্বাধিক-এবং এই তরুণদের স্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. নিয়াজুর রহমান এর সভাপতিত্বে এবং সিরাক-বাংলাদেশ এর উপপরিচালক (প্রোগ্রাম) মোঃ সেলিম মিয়া-র সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এই কর্মশালায় অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন মোঃ মোহাইমিনুল হক সহকারী পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর, এবং জুনায়েদ আহমেদ জনি, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় ।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক জনাব মোঃ মোহাইমিনুল হক বলেন সুনামগঞ্জ বাংলাদেশের অন্যতম জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল, যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে এখানকার কিশোর-কিশোরীদের ওপর। নিয়মিত বন্যা ও জলাবদ্ধতার কারণে অনেকেই স্কুল থেকে ঝরে পড়ে এবং বাল্যবিবাহের হারও এখানে তুলনামূলকভাবে বেশি।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর এর উপপরিচালক মো. নিয়াজুর রহমান বলেন: তরুণদের মৌলিক অধিকারগুলো তারা সঠিকভাবে পাচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা জরুরি। আমরা নীতিমালা তো তৈরি করি, কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা রকম চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। তাই বাস্তব প্রেক্ষাপট বুঝে কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি। হাওর অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও যোগাযোগ-এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ খাতকে বিবেচনায় রেখে কার্যক্রম ডিজাইন করা উচিত। সুনামগঞ্জে বছরের দুটি ভিন্ন প্রাকৃতিক অবস্থা থাকে-একটি সময় যখন চারদিক পানিতে নিমজ্জিত থাকে এবং অন্যটি শুষ্ক মৌসুম। এই দুই সময়ের চাহিদা ও সমস্যাও ভিন্ন। সেক্ষেত্রে কার্যক্রম গ্রহণের সময় উভয় মৌসুমের বাস্তবতা মাথায় রেখে পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।
এছাড়া কর্মশালার বিভিন্ন দলভিত্তিক সেশন পরিচালনা করেন সিরাক-বাংলাদেশ এর ইনোভেশন ও ইয়ুথ স্পেশালিস্ট নাজমুল হাসান, দলগত উপস্থাপনা এবং প্রস্তাবনা পর্ব পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেসি স্পেশালিস্ট মিজানুর রহমান আকন্দ, ও এমইএল অফিসার রুহিয়াত তাসনিম। দলভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে তরুণরা কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নপত্রে মতামত প্রদান করেন এবং তাদের উপস্থাপনাগুলোর ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সুপারিশ দেন।