প্রতিনিধি ২৯ অক্টোবর ২০২৫ , ১০:৫৮:২৫ প্রিন্ট সংস্করণ
বিশেষ প্রতিনিধিঃ ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সোমবার (২৭ অক্টোবর ২০২৫) ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে তিনি এ জবানবন্দি প্রদান করেন।

আদালত সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে নজরুল ইসলাম ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অনিয়ম, আত্মসাৎ, মানিলন্ডারিং ও বিপুল সম্পদ অর্জনের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেন।
তিনি জানান, তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। ২০১৫ সালে ৫ লাখ ৫০ হাজার ডলার ব্যয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েলিংটনে একটি বাড়ি ক্রয় করেন।
নজরুল ইসলাম আরও বলেন, ২০১৪ সালে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের নামে ৩৬ তোপখানা রোডে ২০৭ কোটি টাকায় জমি ক্রয়ের সময় ২৮ কোটি টাকা ভাগাভাগি হয়। এর মধ্যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে ৬ কোটি টাকা পান। পরে জমির বিক্রেতা আজহার হোসেন খানের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তার কাছ থেকে নিজের হিসাবে ১০ কোটি ও স্ত্রীর হিসাবে ৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা স্থানান্তর করেন। এসব অর্থ বিদেশে পাচার করে মানিলন্ডারিং করা হয় বলেও তিনি আদালতে স্বীকার করেন।
তিনি আরও জানান, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এম এ খালেক নিজের নাম ও পরিচিতদের নামে ১১টি প্রতিষ্ঠান গঠন করে ৫৯১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। ওই আত্মসাতে তিনিও সম্পৃক্ত ছিলেন বলে আদালতে স্বীকার করেন।
নজরুলের ভাষ্যমতে, এম এ খালেক, তার ছেলে শাহরিয়ার খালেদ এবং প্রাইম ফাইন্যান্সিয়াল সিকিউরিটিজ, পিএফআই সিকিউরিটিজ, প্রাইমেশিয়া ইউনিভার্সিটি ও প্রাইমেশিয়া ফাউন্ডেশনসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।
তিনি আরও জানান, তিনি ঢাকা বোট ক্লাব, ঢাকা ক্লাব, গুলশান ক্লাবসহ ১৪টি ক্লাবের সদস্য। ২০১৬ সালে ১০ লাখ টাকা দিয়ে ঢাকা বোট ক্লাবের সদস্যপদ নেন এবং বারিধারা ক্লাবের সদস্য হন ২ লাখ টাকা পরিশোধ করে।
জবানবন্দিতে নজরুল ইসলাম দেশে তার ঘোষিত ও অঘোষিত প্রায় ২০০ কোটির বেশি টাকার সম্পদের কথাও জানান। এসব সম্পদের মধ্যে রয়েছে—বারিধারায় ‘পুতুল হাউজ’ নামে ট্রিপ্লেক্স ভবন (বিদেশি নাগরিকদের ভাড়ার জন্য নির্মিত), গুলশান-১ এ ভাসাবি এলাকায় ৩ হাজার ২০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, বারিধারা ডিওএইচএসে ২ হাজার ৮৪১ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, গুলশান-২ এ পাঁচ কাঠা জমির ওপর দুইতলা অফিস ভবন, ভুলতা গাউছিয়ায় এম এ খালেক ও আজহার হোসেনের সঙ্গে যৌথভাবে ‘প্রাইম শপ’ নামে ১৮ কোটি টাকার সম্পদ, মাতুয়াইল ও যাত্রাবাড়ীতে ২ কোটি টাকার সম্পদ, নিকুঞ্জে ‘পুতুল হাউজ’ নামে এক কাঠার ওপর ডুপ্লেক্স ভবন, সিরাজদিখানে আলু কেনা ও উৎপাদনের জন্য কৃষিজমি এবং বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় (২০/২/৫, ব্লক-জি, সায়েম সোবহান রোড) ৩ হাজার ৬০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট।
এছাড়া ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, ফারইস্ট ইসলামী সিকিউরিটিজ, ফারইস্ট ইসলামী প্রোপার্টিজ, সিভিসি ফাইন্যান্স ও ফারইস্ট ফাইন্যান্সসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তার শেয়ার রয়েছে, যার আনুমানিক বাজারমূল্য ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা।
নজরুল ইসলাম বলেন, তার আয়কর নথিতে এসব সম্পদের কিছু অংশ দেখানো হয়েছে, তবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সম্পদ অন্যদের নামে বা সরাসরি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে।
তিনি আদালতে আরও বলেন, আমার নেতৃত্বে থাকা সময়ে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেন স্বচ্ছ ছিল না। এম এ খালেক ও ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের মাধ্যমে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে, যার অংশ আমিও পেয়েছি।
ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সে অনিয়ম, আত্মসাৎ ও অর্থপাচারসংক্রান্ত মামলার তদন্তে এ জবানবন্দিকে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র।
জানা গেছে, ফারইস্ট ইসলামী লাইফের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামকে গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর বংশাল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পরে তাকে আদালতে সোপর্দ করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। শুনানি নিয়ে তার পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ সাব্বির ফয়েজ।
মামলার এজাহারে বলা হয়, পরস্পর যোগসাজশে আসামিরা রাজধানীর তোপখানা রোডের জমি কেনার ক্ষেত্রে প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয় নেন। এর মাধ্যমে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের ৪৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলামসহ অন্যরা।
এদিকে দুদকের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নজরুল ইসলাম চেয়ারম্যান থাকাকালে অন্য আসামিদের সঙ্গে যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। এ ছাড়া নজরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী তাসলিমা ইসলাম যৌথভাবে প্রায় ১৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা অবৈধভাবে গ্রহণ করে আত্মসাৎ করেছেন। এ ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, দণ্ডবিধি এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা করা হয়েছে।

















