সারাদেশ

ডক্টরস কমিউনিটি ক্লিনিক বন্ধের ষড়যন্ত্র: উলিপুরের এক আলো নিভিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা

  প্রতিনিধি ১ নভেম্বর ২০২৫ , ২:০৫:৫৬ প্রিন্ট সংস্করণ

উলিপুর পৌর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ডক্টরস কমিউনিটি ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনোস্টিক সেন্টার—রাজারহাট, উলিপুর ও চিলমারী উপজেলার মানুষের কাছে দীর্ঘদিনের এক আস্থার নাম। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই ক্লিনিক নামমাত্র ফি-তে চিকিৎসা দিয়ে আসছে। এমনকি বহু গরিব অসহায় মানুষ এখানে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা পেয়েছে। মানবিকতা ও দায়িত্ববোধ থেকেই ক্লিনিকটি চিকিৎসাকে ব্যবসা নয়, সেবা হিসেবে গ্রহণ করেছে। অথচ সেই প্রতিষ্ঠানটিই আজ ষড়যন্ত্রের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। গত ২০ অক্টোবর মিথী আক্তার নামে এক গর্ভবতী নারী প্রসব বেদনা নিয়ে ক্লিনিকে ভর্তি হন। দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকেরা পরীক্ষা করে দেখেন, প্রসব জটিল এবং গর্ভস্থ শিশুর হার্টবিট অস্বাভাবিকভাবে দ্রুত। চিকিৎসকেরা রোগীর ও শিশুর নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সিজারিয়ান অপারেশনের পরামর্শ দেন। কিন্তু রোগীর স্বজনরা সিজারে রাজি না হয়ে স্বাভাবিক প্রসবের অনুরোধ করেন। চিকিৎসকেরা তাদের সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্বাভাবিক প্রসব করান। বিকেল ৬টার দিকে শিশুটির জন্ম হয়, কিন্তু জন্মের পরপরই নবজাতকের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। চিকিৎসকেরা তৎক্ষণাৎ অক্সিজেন, অ্যান্টিবায়োটিক ও প্রয়োজনীয় ওষুধ প্রয়োগ করেন এবং দ্রুত রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান।

 

সেখানে নেওয়ার পর নবজাতকটি মারা যায়। এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে কিছু ব্যক্তি ক্লিনিকের বিরুদ্ধে “নবজাতক হত্যার” অভিযোগ তোলে। এরপর মানববন্ধন, বিক্ষোভসহ বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে তারা ক্লিনিকটির সুনাম ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা চালাচ্ছে। অথচ বিষয়টি নিয়ে থানায় অভিযোগ হওয়ার পর উভয় পক্ষের মধ্যে মীমাংসাও হয়েছে বলে জানা গেছে। এ অবস্থায় একটি দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত ক্লিনিক বন্ধের দাবি কতটা যৌক্তিক, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন। গাইনী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, “প্রসবের সময় যদি শিশুর হার্টবিট অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, তখন সিজার ছাড়া বিকল্প থাকে না। কিন্তু রোগীর স্বজনরা তা মানেননি। আমরা তাদের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়েও সর্বোচ্চ চিকিৎসা দিয়েছি। এটি হত্যা নয়, এটি চিকিৎসাগত জটিলতা।” তিনি আরও বলেন, “একটি শিশুর মৃত্যু আমাদের মতো চিকিৎসকদের জন্যও কষ্টের। অথচ এখন আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, যা অত্যন্ত হতাশাজনক।” ৩০ অক্টোবর বিকেলে ক্লিনিক প্রাঙ্গণে সংবাদ সম্মেলন করে পরিচালনা পর্ষদ অভিযোগ তোলে যে কিছু ব্যক্তি পরিকল্পিতভাবে ডক্টরস ক্লিনিককে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে। পরিচালনা পর্ষদের পক্ষে ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, “আমরা চিকিৎসক হিসেবে মানবসেবাকে দায়িত্ব হিসেবে দেখি।

 

এই ক্লিনিক গরিব মানুষের সেবায় নিবেদিত। একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাকে পুঁজি করে আমাদের বন্ধের দাবি অন্যায়। তদন্ত হোক, সত্য প্রকাশ পাক—তবেই ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচিত হবে।” কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন ইতোমধ্যে ঘটনাটি তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছেন। তারা ক্লিনিকের নথি, চিকিৎসা প্রক্রিয়া ও সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য নিয়ে প্রতিবেদন দেবে। স্থানীয় জনগণ বলছে, সত্যিকারের চিকিৎসা দুর্ঘটনাকে ষড়যন্ত্রে রূপ দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ হওয়া উচিত। উলিপুরের স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুল কাদের বলেন, “ডক্টরস ক্লিনিকের ডাক্তাররা গরিব মানুষদের বিনা পয়সায় সেবা দেন। একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে এত বড় প্রতিষ্ঠান বন্ধের দাবি করা অন্যায়।” আরেক রোগী রহিমা বেগম বলেন, “আমার সন্তানও এখানেই জন্মেছে, তারা কখনও টাকার লোভ দেখায়নি। আল্লাহর ইচ্ছায় শিশুটি মারা গেলে সেটা হত্যাকাণ্ড হয় কীভাবে?” এমন অসংখ্য রোগীর সাক্ষ্য প্রমাণ করে, ডক্টরস কমিউনিটি ক্লিনিক শুধু একটি চিকিৎসা কেন্দ্র নয়, এটি উলিপুরের মানুষের মানবিক আশ্রয়। এই ক্লিনিক বন্ধ হয়ে গেলে ক্ষতি হবে গরিব মানুষের, ব্যাহত হবে স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবা। একটি নবজাতকের মৃত্যু নিঃসন্দেহে বেদনাদায়ক, কিন্তু সেই ঘটনার আড়ালে যদি ষড়যন্ত্র থেকে থাকে, তবে সেটিই হবে আরও ভয়াবহ। উলিপুরবাসী এখন অপেক্ষায়—প্রশাসনিক তদন্তের ফলাফলে সত্য প্রমাণিত হোক, এবং যে আলো মানবসেবায় জ্বলে উঠেছিল, সেটি যেন ষড়যন্ত্রের অন্ধকারে নিভে না যায়।

Author

আরও খবর

Sponsered content